টেকসিঁড়ি রিপোর্ট : শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের নেতিবাচক প্রভাব নিয়ে বিশ্বজুড়ে উদ্বেগ এখন চরমে। বিষণ্ণতা, উদ্বেগ এবং আত্মমর্যাদাবোধের অভাবের মতো সমস্যার জন্য অনেক দেশে সরকার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো সরাসরি সোশ্যাল মিডিয়া জায়ান্টদের কাঠগড়ায় দাঁড় করাচ্ছে।
সিগারেটের প্যাকেটে যেমন স্বাস্থ্যের ক্ষতির সতর্কবার্তা থাকে, এবার অনেকটা সেই আদলেই ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম বা টিকটকের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে সতর্কবার্তা দেখানোর বাধ্যবাধকতা জারি করল নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্য।
শুক্রবার ,২৬ ডিসেম্বর, ২০২৫ গভর্নর ক্যাথি হোকুল এই সংক্রান্ত একটি বিলে স্বাক্ষর করে সেটিকে আইনে রূপান্তর করেছেন।
নিউইয়র্কের নতুন আইনের ফলে এখন থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোকে তাদের প্ল্যাটফর্মে থাকা ‘আসক্তিমূলক’ ফিচারের কারণে মানসিক স্বাস্থ্যের সম্ভাব্য ঝুঁকি নিয়ে সতর্কবার্তা (Warning Label) দেখাতে হবে।
এই আইনটি মূলত তরুণ ব্যবহারকারীদের মানসিক স্বাস্থ্যের সুরক্ষায় তৈরি করা হয়েছে। বিশেষ করে যে ফিচারগুলো ব্যবহারকারীদের দীর্ঘক্ষণ স্ক্রিনে আটকে রাখতে বাধ্য করে, সেগুলোর বিরুদ্ধেই এই ব্যবস্থা। ফিচারগুলি হলো –
ইনফিনিট স্ক্রলিং (Infinite Scrolling): নিচ থেকে উপরের দিকে একের পর এক কন্টেন্ট আসার প্রক্রিয়া।
অটো-প্লে (Autoplay): একটি ভিডিও শেষ হওয়ার পর স্বয়ংক্রিয়ভাবে অন্যটি শুরু হওয়া।
অ্যালগরিদমিক ফিড (Algorithmic Feeds): ব্যবহারকারীর পছন্দ অনুযায়ী এআই বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে কন্টেন্ট পরিবেশন করা।
সতর্ক বার্তা যেভাবে কাজ করবে
শুরুতেই সতর্কতা: একজন তরুণ ব্যবহারকারী যখন প্রথমবার কোনো আসক্তিমূলক ফিচার ব্যবহার করতে যাবেন, তখনই পর্দায় এই সতর্কবার্তা ভেসে উঠবে।
নির্দিষ্ট সময় পর পর: ব্যবহারকারী দীর্ঘক্ষণ অনলাইনে থাকলে ৩ ঘণ্টা পর ৩০ সেকেন্ডের জন্য এবং পরবর্তীতে প্রতি ঘণ্টায় এটি আবার প্রদর্শিত হবে।
এড়িয়ে যাওয়র সুযোগ নেই: ব্যবহারকারী এই সতর্কবার্তাগুলো এড়িয়ে যেতে (Skip) বা দ্রুত সরিয়ে দিতে পারবেন না। অন্তত ১০ সেকেন্ড এটি স্ক্রিনে স্থায়ী থাকবে।
গভর্নরের বক্তব্য ও শাস্তির বিধান
গভর্নর হোকুল এই পদক্ষেপকে তামাকজাত পণ্য বা প্লাস্টিক প্যাকেজিংয়ের সতর্কবার্তার সঙ্গে তুলনা করে বলেছেন, “নিউইয়র্কবাসীদের নিরাপদ রাখা আমার সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। আমাদের শিশুদের এমন আসক্তিমূলক ফিচার থেকে রক্ষা করা জরুরি যা তাদের অত্যধিক ব্যবহারে উৎসাহিত করে।”
গবেষণায় দেখা গেছে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অত্যধিক ব্যবহার মস্তিষ্কের ‘রিওয়ার্ড সেন্টার’-কে এমনভাবে উত্তেজিত করে যা অনেকটা মাদক বা জুয়ার আসক্তির মতো। কোনো প্ল্যাটফর্ম এই আইন লঙ্ঘন করলে প্রতি লঙ্ঘনের জন্য ৫,০০০ ডলার (প্রায় ৬ লাখ টাকা) পর্যন্ত জরিমানার মুখে পড়তে পারে।
প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া
এই আইনটি শুধুমাত্র নিউইয়র্ক সীমানার ভেতরে থাকা ব্যবহারকারীদের জন্য কার্যকর হবে। এর আগে ক্যালিফোর্নিয়া এবং মিনেসোটা অঙ্গরাজ্যেও একই ধরনের আইন কার্যকর করা হয়েছে। তবে টিকটক, মেটা বা অ্যালফাবেটের মতো টেক জায়ান্টরা এই বিষয়ে এখনও আনুষ্ঠানিক কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি।
শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর সোশ্যাল মিডিয়ার বিরূপ প্রভাব এখন একটি বিশ্বব্যাপী উদ্বেগ। এই সংকট মোকাবিলায় বিশ্বজুড়ে দেশ এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো কঠোর পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছে। এই লড়াইয়ে সবচেয়ে বৈপ্লবিক পদক্ষেপ নিয়েছে অস্ট্রেলিয়া।
এ মাসের শুরুতে (১০ ডিসেম্বর, ২০২৫) দেশটিতে একটি নতুন আইন কার্যকর হয়েছে, যার মাধ্যমে ১৬ বছরের কম বয়সীদের জন্য ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, ইউটিউব, টিকটক এবং স্ন্যাপচ্যাটের মতো প্ল্যাটফর্মগুলো ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
সাইবার বুলিং এবং অনলাইনে শিশুদের মানসিক ও যৌন নির্যাতন থেকে সুরক্ষা দিতে আইনটি কার্যকর হওয়ার সাথে সাথেই ১৬ বছরের কম বয়সী লাখ লাখ কিশোর-কিশোরীর অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। শুধু তাই নয় কোনো প্ল্যাটফর্ম এই নিয়ম ভঙ্গ করলে তাদের ৫ কোটি অস্ট্রেলিয়ান ডলার পর্যন্ত জরিমানা গুনতে হতে পারে।
মালয়েশিয়া ও ডেনমার্ক শীঘ্রই একই ধরনের জাতীয় নিষেধাজ্ঞা জারির পরিকল্পনা করছে। ডেনমার্ক শিশুদের জন্য ১৫ বছর বয়সসীমা নির্ধারণের কথা ভাবছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের যুক্তরাজ্য, জার্মানি এবং ফ্রান্স ইতিমধ্যেই শিশুদের জন্য সোশ্যাল মিডিয়া আইন অনেক বেশি কঠোর করেছে, যেখানে বয়স যাচাইকরণ (Age Verification) এবং অ্যালগরিদমিক ফিডের ওপর কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে।
গবেষণা বলছে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অতিরিক্ত ব্যবহার মস্তিষ্কের ডোপামিন নিঃসরণকে প্রভাবিত করে যা মাদকাসক্তির মতোই ক্ষতিকর। এই পরিস্থিতি সামলাতে বিশেষজ্ঞরা অভিভাবকদের ডিভাইস ব্যবহারের ওপর কড়া নজরদারি এবং শিশুদের জন্য টেক-ফ্রি জোন (যেমন: খাবার টেবিল বা শোবার ঘর) তৈরির পরামর্শ দিচ্ছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের কয়েক হাজার স্কুল ডিস্ট্রিক্ট মেটা (ফেসবুক-ইনস্টাগ্রাম), বাইটড্যান্স (টিকটক) এবং অ্যালফাবেটের (ইউটিউব) বিরুদ্ধে মামলা করেছে। তাদের অভিযোগ:
১. পরিকল্পিত আসক্তি: এই কোম্পানিগুলো জেনেশুনেই এমন ফিচার (যেমন: ইনফিনিট স্ক্রলিং) তৈরি করেছে যা শিশুদের আসক্ত করে।
২. অতিরিক্ত খরচ: শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্য সংকট সামলাতে স্কুলগুলোকে বাড়তি কাউন্সিলর নিয়োগ এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিতে হচ্ছে, যার ক্ষতিপূরণ তারা কোম্পানিগুলোর কাছে দাবি করছে।
৩. মানসিক সংকট: পড়াশোনায় অমনোযোগিতা, সাইবার বুলিং এবং শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতির জন্য এই অ্যাপগুলোকে দায়ী করা হচ্ছে।
সুত্র আল জাজিরা


