টেকসিঁড়ি ফিচারঃ একসময় ফেসবুক ছিল শুধুই বন্ধু-বান্ধব ও পরিচিতদের সঙ্গে যোগাযোগের একটি মাধ্যম। ব্যক্তিগত মুহূর্ত, ছবি আর ভাবনা শেয়ার করার নিরাপদ প্ল্যাটফর্ম। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে এর রূপ বদলেছে। ফেসবুক কেবল যোগাযোগের প্ল্যাটফর্ম নয়, এটি আয়েরও একটি উৎস। ফেসবুক রিলস, ইন-স্ট্রিম অ্যাডস, স্টারস – সব মিলিয়ে মনিটাইজেশনের অসংখ্য পথ খুলে গেছে। আর এখানেই জন্ম নিয়েছে এক নতুন বিতর্ক: ফেসবুক মনিটাইজেশন কি আমাদের ব্যক্তিত্বের জন্য সংকট তৈরি করছে, নাকি এটি নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিচ্ছে? সংকট ও সম্ভাবনার এই বিশ্লেষণধর্মী ফিচারটি লিখেছেন প্রকৌশলী সামিউল হক সুমন, নির্বাহী সম্পাদক, টেকসিঁড়ি ডট কম।
ব্যক্তিত্বের সংকট: যখন ‘আমি’ হয়ে যায় ‘পণ্য’
মনিটাইজেশনের এই যুগে আমরা প্রায়ই দেখি, মানুষ তাদের জীবনের অতি ব্যক্তিগত মুহূর্তগুলোকেও প্রকাশ করছে শুধুমাত্র ভিউ বা লাইক বাড়ানোর জন্য। সকালে ঘুম থেকে ওঠা থেকে শুরু করে রাতে ঘুমানো পর্যন্ত, প্রতিটি কার্যকলাপই হয়ে যাচ্ছে কনটেন্ট। যখন আপনার ব্যক্তিগত জীবন ক্যামেরার লেন্সের মধ্য দিয়ে ফিল্টার হতে থাকে, তখন এর স্বাভাবিকতা আর থাকে না।
অনেক কনটেন্ট ক্রিয়েটর কেবল দর্শককে খুশি করার জন্য এমন কিছু করতে বাধ্য হন যা তাদের নিজস্ব ব্যক্তিত্বের সাথে মেলে না। সস্তা জনপ্রিয়তা পাওয়ার জন্য অনেক সময় অতিরঞ্জিত বা আপত্তিকর কনটেন্টও তৈরি করা হয়। এখানে ‘আমি’ আর ‘আমার’ থাকে না, থাকে কেবল ‘আমার ভিউয়ার’ এবং ‘তার চাহিদা’। এই চাহিদা মেটাতে গিয়ে নিজের মৌলিকতা ও স্বকীয়তা বিসর্জন দিতে হয়। যখন একজন মানুষ তার নিজের পরিচিতি ভুলে গিয়ে কেবল দর্শকদের চাহিদামতো একটি চরিত্রে অভিনয় করে, তখনই ব্যক্তিত্বের সংকট তৈরি হয়।
সম্ভাবনার দিগন্ত: যখন ‘আমি’ হয়ে ওঠে ‘প্রভাবক’
অন্যদিকে, মনিটাইজেশনকে কেবল নেতিবাচক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা ঠিক নয়। ফেসবুক মনিটাইজেশন অসংখ্য মানুষের জন্য নতুন আয়ের পথ খুলে দিয়েছে। যারা সুপ্ত প্রতিভা থাকা সত্ত্বেও কোনো প্ল্যাটফর্ম পাচ্ছিলেন না, তারা এখন ফেসবুকের মাধ্যমে নিজেদের দক্ষতা তুলে ধরতে পারছেন। একজন গৃহিণী তার রান্নার রেসিপি দেখিয়ে সফল ‘ফুড ব্লগার’ হতে পারছেন, একজন শিক্ষার্থী তার শিক্ষণীয় ভিডিও দিয়ে হাজার হাজার মানুষকে সাহায্য করতে পারছেন।
মনিটাইজেশন এই মানুষগুলোকে স্বাবলম্বী হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। তারা এখন নিজেদের শখ বা দক্ষতাকে পেশায় পরিণত করতে পারছেন। এর মাধ্যমে তাদের আত্মবিশ্বাস বাড়ছে, সামাজিক স্বীকৃতিও মিলছে। মনিটাইজেশন একটি শক্তিশালী প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে যেখানে একজন ব্যক্তি তার পছন্দের বিষয় নিয়ে কাজ করতে পারেন এবং একইসাথে আর্থিক স্বাধীনতা অর্জন করতে পারেন। যখন কেউ তার সৃষ্টিশীলতাকে কাজে লাগিয়ে একটি ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারেন, তখন তা তার ব্যক্তিত্বকে আরও সমৃদ্ধ করে।
সবশেষ
তাহলে কি ফেসবুক মনিটাইজেশন ব্যক্তিত্বের সংকট নাকি সম্ভাবনা? উত্তরটা নির্ভর করে আপনি কীভাবে এটিকে ব্যবহার করছেন তার ওপর। যদি আপনি কেবল অর্থ উপার্জনের জন্য নিজের স্বকীয়তা বিসর্জন দেন, নিজেকে একটি পণ্যে পরিণত করেন, তাহলে এটি অবশ্যই একটি সংকট। কিন্তু যদি আপনি আপনার মেধা, দক্ষতা ও সৃজনশীলতাকে কাজে লাগিয়ে ইতিবাচক কনটেন্ট তৈরি করেন এবং এর মাধ্যমে নিজের ও সমাজের উপকার করেন, তবে এটি নিঃসন্দেহে সম্ভাবনার নতুন দুয়ার খুলে দেবে।