টেকসিঁড়ি রিপোর্টঃ ২০তম বাংলাদেশ ইন্টারনেট গভর্নেন্স ফোরাম (BIGF) ২০২৫-এর সমাপনী অনুষ্ঠানে এসে দেশের সামগ্রিক ডিজিটাল ক্ষেত্রকে ঢেলে সাজানোর জন্য সরকারের ঐতিহাসিক মহাপরিকল্পনার বিস্তারিত তুলে ধরলেন ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের মুখ্য উপদেষ্টার বিশেষ সহায়ক ফাইজ় তাইয়েব আহমেদ।
তাঁর বক্তব্যে তিনি একটি বিশাল কর্মযজ্ঞের ঘোষণা দেন, যার লক্ষ্য হলো দেশের সাইবার নিরাপত্তা, ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষা, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) মাস্টার প্ল্যান, টেলিযোগাযোগ নীতি এবং ডাকনীতিকে এক ছাতার নিচে এনে একটি শক্তিশালী ও আধুনিক আইনি কাঠামো তৈরি করা।
“২০তম বিআইএফজি ২০২৫ এর সফল সমাপ্তি আগামীর স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। এই ফোরাম থেকে প্রাপ্ত দিকনির্দেশনা ও আলোচনাগুলো আমাদের ডিজিটাল পলিসি প্রণয়ন এবং সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে সহায়ক হবে। বিশেষত, দেশের সামগ্রিক ডিজিটাল ক্ষেত্রকে ঢেলে সাজাতে এবং ডিজিটাল পাবলিক ইনফ্রাস্ট্রাকচার (ডিপিআই)-এর জন্য একটি শক্তিশালী আইনি ভিত্তি তৈরি করতে সরকার যে ঐতিহাসিক কর্মযজ্ঞ শুরু করেছে, তা দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে। পুরনো ১৮৮৫ সালের ডাক-আইনের নজরদারির ক্ষমতা ভেঙে এখন আমরা তথ্য সুরক্ষা, ডেটা গভর্নেন্স এবং আন্তঃমন্ত্রণালয়ীয় ডেটা সিলো একীভূতকরণের মাধ্যমে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কাজ করছি।”
ফাইজ় তাইয়েব আহমেদ উল্লেখ করেন, এই উদ্যোগের মূলে রয়েছে ১৮৮৫-৮৭ সালের পুরনো ডাক-আইন, যা মূলত নজরদারি (সার্ভেইল্যান্স) ক্ষমতাকে প্রাধান্য দিত। তিনি বলেন, “সেই পুরনো আইনগত কাঠামো ভেঙে নতুনভাবে গড়ার চেষ্টা চলছে। গত ৫-৬ মাসের স্বল্প সময়ের মধ্যে ৫-৬ বছরের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে দ্রুতগতিতে এই কাজ শুরু হয়েছে।”
নতুন আইনি কাঠামো এবং নীতিমালার ব্লুপ্রিন্ট
সরকারের লক্ষ্য হলো একটি শক্ত ভিত্তি তৈরি করা, যার মাধ্যমে এমনকি সরকারের অভ্যন্তরীণ তদন্ত প্রক্রিয়াও স্পষ্ট হবে। এজন্য প্রণয়ন করা হচ্ছে, ডিজিটাল পাবলিক ইনফ্রাস্ট্রাকচারে একটি আইনগত ভিত্তি ও স্তবায়নযোগ্য তথ্য শাসন (ডেটা গভর্নেন্স) নীতি ও তথ্য সুরক্ষা আইন।
এই মূল ম্যান্ডেটের অধীনে আরও যে সব নীতিমালা তৈরির কাজ চলছে তার মধ্যে রয়েছে: ক্লাউড নীতি, এআই নীতি, এন্টারপ্রাইজ-হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যার কোয়ালিটি অ্যাসেসমেন্ট নীতি, সম্মিলিত টেলিযোগাযোগ নীতি, ইন্টারনেট নীতি ও নজরদারি নীতি, এবং ই-কমার্স ও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে একীভূত করে ডাকপ্রণালী।
ডেটা গভর্নেন্সে আমূল পরিবর্তন
তথ্য শাসনের ক্ষেত্রে সরকার একটি আমূল পরিবর্তন আনছে। তিনি জানান, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এবং অন্যান্য সংস্থাগুলোকে এখন আর উপাত্তের মালিক হিসেবে নয়, বরং তথ্য বিশ্বাসপাত্র (Data Fiduciary) হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে। উপাত্তের মালিক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে তথ্য সংগ্রহকারীকে। বিবিএস এখন থেকে সকল সরকারি মন্ত্রণালয় থেকে ডেটাবেস থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে মাসিক এপিআই (API)-এর মাধ্যমে উপাত্ত সংগ্রহ করবে, যা তথ্যের নির্ভুলতা নিশ্চিত করবে এবং প্রথাগত জনসংখ্যা গণনার প্রয়োজনীয়তা কমিয়ে আনবে।
জাতীয় সংযোগের রূপরেখা
বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে একটি “ডিজিটাল স্টার্টআপ” প্রকল্পের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, বর্তমান ‘ডিজিটাল সিলো’ (বিচ্ছিন্ন উপাত্ত ভান্ডার) গুলোকে একীভূত করার জন্য একটি জাতীয় এপিআই এক্সচেঞ্জ ও একটি জাতীয় সংযোগ বাস (National Connectivity Bus) তৈরি করা হবে। এই সংযোগ বাস পরিচালনার জন্য একটি জাতীয় সংযোগ মধ্যস্থ সার্ভার (National Connectivity Mediation Server) স্থাপন করা হবে।
শক্তিশালী তদারকি কর্তৃপক্ষ ও ডেটা ব্রোকার গঠন
বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের (বিসিসি) অধীনে থাকা তদারকি প্রক্রিয়াকে সরিয়ে একটি নতুন শক্তিশালী জাতীয় গোষ্ঠী প্রতিষ্ঠা করা হবে। এই গোষ্ঠীতে ডেটা ব্রোকার (তথ্য বিজ্ঞানী ও তথ্য আইনজ্ঞ), কমপ্লায়েন্স টিম এবং এনফোর্সমেন্ট (বাস্তবায়ন) টিম থাকবে, যা দুর্নীতি ও মানবাধিকার লঙ্ঘন রোধে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করবে।
অনুষ্ঠানের শেষে ফাইজ় তাইয়েব আহমেদ আশাবাদ ব্যক্ত করেন যে, এই কেন্দ্রীয় বাস ও সেক্টরাল হাবগুলো পুরোপুরি ইনস্টল হলে ডিজিটাল রিসোর্সে প্রবেশাধিকারের সমস্যার সমাধান হবে এবং এটি ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়ার পথে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে।

