টেকসিঁড়ি রিপোর্ট : সীমিত ও মূল্যবান তরঙ্গের (স্পেকট্রাম) যথাযথ ব্যবহার, সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা এবং সময়োপযোগী কর্মপরিকল্পনা গ্রহণে করণীয়সহ টেলিযোগাযোগ খাতের বিভিন্ন বিষয়ে সদস্য দেশ ও টেলিযোগাযোগ খাত সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের মধ্যে জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা বিনিময়ের মধ্য দিয়ে শেষ হলো ৩ দিনব্যাপী আন্তর্জাতিক তরঙ্গ ব্যবস্থাপনা সিম্পোজিয়াম।
১৮ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হওয়া এই সিম্পোজিয়াম যৌথভাবে আয়োজন করেছে এশিয়া প্যাসিফিক টেলিকমিউনিটি (এপিটি) ও বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)। তিন দিনব্যাপী ১১টি সেশনে মোট ৩৮টি টেলিযোগাযোগ ও তথ্য প্রযুক্তি সংশ্লিষ্ট নিবন্ধ উপস্থাপনা করা হয়।
সমাপনী অধিবেশনে বিটিআরসির স্পেকট্রাম বিভাগের কমিশনার মাহমুদ হোসেন বলেন, সিম্পোজিয়াম জুড়ে ব্যান্ডউইথের ক্রমবর্ধমান চাহিদা থেকে শুরু করে জাতীয় স্পেকট্রাম কৌশল তথা মূল্যবান তরঙ্গের দক্ষ, ন্যায়সঙ্গত ও উদ্ভাবনী ব্যবহার, আঞ্চলিক সহযোগিতা, সম্প্রীতি এবং একসঙ্গে কাজ করার প্রয়োজনীয়তাকে পুনর্ব্যক্ত করা হয়েছে। আয়োজক হিসেবে বাংলাদেশকে নির্বাচন করায় এপিটির প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন তিনি।
সিম্পোজিয়ামের প্রথম দিনে ‘Connectivity needs and national spectrum strategy’ র্শীর্ষক তিনটি প্যানেল আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। ডিজিটাল কানেক্টিভিটি, জাতীয় তরঙ্গ কৌশলের উন্নয়ন ও এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোতে গৃহীত কর্মকৌশল নিয়ে আলোচনা হয়।

এশিয়া প্যাসিফিক টেলিকমিউনিটির প্রোগ্রাম অফিসার ফরহাদুল পারভেজ এর সঞ্চালনায় এতে অংশগ্রহণ করেন বিটিআরসির স্পেকট্রাম বিভাগের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো: আমিনুল হক, জাপানের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কমিউনিকেশন টেকনোলজি এর জেষ্ঠ্য সমন্বয়ক ড. কোহে সাতোহ (Dr. Kohei Satoh) লিথুনিয়ার ভিলনিয়াস টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটির সহযোগী অধ্যাপক ড. আরতুরাস মেডেইসিস (Dr. Arturas Medeisis) , কোরিয়ার ন্যাশানাল রেডিও রিসার্চ এজেন্সির সহকারী পরিচালক সিউং ইউকেইন (Seung-uk Kwon), ভারতের ম্যানেজমেন্ট ডেভেলপমেন্ট ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক রোহিত প্রসাদ, GSMA এর স্পেকট্রাম বিভাগের পরিচালক ইশেন চান ( Yishen Chan), গ্লোবাল স্যাটেলাইট অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন (GSOA) এর মহাপরিচালক ইসাবেলে মাউরো (Isabelle Mauro)।
এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ডিজিটাল কানেক্টিভিটি, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য প্রযুক্তি বিকাশে তরঙ্গের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে আলোচকরা বলেন, ওয়্যারলেস কানেক্টিভিটির মাধ্যমে সাশ্রয়ী ও উচ্চ-গতির ইন্টারনেট সুবিধা প্রদান, ডিজিটাল ডিভাইড হ্রাস, দূরবর্তী নেটওয়ার্ক কভারেজ এবং বৈচিত্র্যময় ডিজিটাল পরিষেবা খুব সহজে দেয়া সম্ভব।
বিশ্বব্যাপী ওয়্যারলেস প্রযুক্তিতে নতুন নতুন যে উদ্ভাবন রয়েছে তা বিবেচনায় নিয়ে তরঙ্গ নীতির আধুনিকীকরণ এবং সীমিত জাতীয় সম্পদের সর্বাধিক ব্যবহারের লক্ষ্যে সমষ্টিগত কর্মকৌশল প্রণয়নের ওপর আলোকপাত করেন তারা।
দ্বিতীয় দিনের প্রথমার্ধে ‘Meeting the demands for bandwidths- Spectrum outlook and developing spectrum roadmap’ শীর্ষক অধিবেশনে বিভিন্ন পরিষেবা ও অ্যাপ্লিকেশনের জন্য স্পেকট্রাম চাহিদা, জাতীয় তরঙ্গ কৌশল সংক্রান্ত প্রস্তুতি এবং দীর্ঘমেয়াদী স্পেকট্রাম রোডম্যাপ মূল্যায়নে করণীয় নিয়ে আলোচনা হয়।
অস্ট্রেলিয়ার উইন্ডশোর প্যালেস কনসাল্টিং এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক স্কট ডব্লিউ মিনেহান (Scott W Minehane) সঞ্চালনায় এতে অংশগ্রহণ করেন বিটিআরসির স্পেকট্রাম বিভাগের পরিচালক ড. সোহেল রানা, ইরানের কমিউনিকেশন রেগুলেটরি অথোরিটি, থাইল্যান্ডের ন্যাশনাল ব্রডকাস্টিং এন্ড টেলিকমিউনিকেশন কমিশন এবং অষ্ট্রেলিয়ার কমিউনিকেশন এন্ড মিডিয়া অথোরিটি থেকে আগত প্রতিনিধিগণ।
বেতার প্রযুক্তিকেন্দ্রিক নতুন নতুন উদ্ভাবনের কারণে তরঙ্গের চাহিদা দ্রুত গতিতে বাড়ছে উল্লেখ করে আলোচকরা বলেন, ২০২৩ সালে অনুষ্ঠিত বিশ্ব রেডিও সম্মেলনের ফলাফল থেকে এটা স্পষ্ট যে পরবর্তী প্রজন্মের তারবিহীন নেটওয়ার্ক, লো অরবিট স্যাটেলাইট পরিষেবা, ৫জি এবং ৬জি ব্রডব্যান্ড নেটওয়ার্ক, চালকবিহীন যানবাহন এবং উন্নত ড্রাইভিং সিস্টেমের উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়েছে। তাই জাতীয় তরঙ্গ কৌশলের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত সীমিত সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার এবং সমগ্র জাতি উপকৃত হয় এমন প্রযুক্তি এবং পরিষেবার কাজে তা ব্যবহার করা।
দ্বিতীয়ার্ধে ‘Meeting the demands for bandwidths – Spectrum outlook and developing spectrum roadmap’ শীর্ষক প্যানেল আলোচনায় লাইসেন্স প্রদান , স্পেকট্রামের মূল্য নির্ধারণ সম্পর্কিত বর্তমান নীতি পর্যালোচনা, স্যাটেলাইট টেকনোলজি, ৫জি (5G) , ৬জি (6G) এবং নতুন প্রযুক্তির জন্য তরঙ্গ নিলাম নিয়ে আলোচনা হয় ।
লিথুনিয়ার ভিলনিয়াস টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটির সহযোগী অধ্যাপক ড, আরতুরাস মেডেসিস (Dr. Arturas Medeisis) এর সঞ্চলনায় এতে ভিয়েতনামের রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি ম্যানেজমেন্ট অথোরিটি, ভারতের টেলিকম রেগুলেটরি অথোরিটি, Meta, Amazon, Viasat, এরিকসন, হুয়াওয়ে ও নোকিয়ার প্রতিনিধিগণ অংশগ্রহণ করেন।
একটি দেশের জাতীয় ডিজিটাল কানেক্টিভিট, আর্থিক ও সামাজিক প্রবৃদ্ধিকে বিবেচনায় নিয়ে তরঙ্গের মূল্য নির্ধারণ ও এর যথাযথ ব্যবহারের লক্ষ্যে রেগুলেটরি পলিসি নির্ধারণের পরামর্শ দেন তারা।
সিম্পোজিয়ামের তৃতীয় দিনের প্রথমার্ধে ‘Key regulatory considerations for the future use of spectrum’ শীর্ষক অধিবেশনে ক্রস বর্ডার তরঙ্গ সমন্বয়, সদস্য দেশসমূহের মধ্যে অভিজ্ঞতা বিনিময় নিয়ে আলোচনা হয়। প্যানেল আলোচকগণ বলেন, যেহেতু বেতার যোগাযোগ প্রযুক্তি দ্রুত গতিতে পরিবর্তিত হচ্ছে, তাই নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোকেও ভবিষ্যতে রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি স্পেকট্রামের দক্ষ ব্যবহার নিশ্চিত করা গুরুত্বপূর্ণ ।
এ জন্য রেগুলেটরি সংস্থাকে নতুন এবং উদ্ভাবনী ধারণার ওপর গুরুত্ব প্রদান, স্পেকট্রাম শেয়ারিং, স্পেকট্রাম লিজিং, তরঙ্গ পুনর্নির্মাণ, রি-ফার্মিংসহ আঞ্চলিক এবং বৈশ্বিক পর্যায়ে তরঙ্গ সমন্বয় করতে হবে। জাপানের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কমিউনিকেশন টেকনোলজি ,ইন্দোনেশিয়ার কমিউনিকেশন এন্ড ডিজিটাল অ্যাফেয়ার্স, GSMA ও জাপানের কেডিডিআই কর্পোরেশন এর কর্মকর্তাগণ এতে অংশগ্রহণ করেন।
দ্বিতীয়ার্ধে ‘Assessing spectrum management practices-Application of innovative techniques and tools in spectrum management’ শীর্ষক প্যানেল আলোচনায় জাতীয় তরঙ্গ কৌশলে উদ্ভাবনী প্রযুক্তি, কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা, ইন্টারনেট অব থিংগস ব্যবহারের দিক আলোচনা হয়।
বিটিআরসির স্পেকট্রাম বিভাগের কমিশনার মাহমুদ হোসেন এর সঞ্চালনায় আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন কোরিয়ার কমিউনিকেশন কনফরমিটি অ্যাসেসমেন্ট সেন্টার এর মহাপরিচালক চ্যাং ইয়ং সন (Chang Yong Son),লিথুনিয়ার ভিলনিয়াস টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ড. আরতুরাস মেডেসিস (Dr. Arturas Medeisis) এবং এপিটির প্রোগ্রাম অফিসার ফরহাদুল পারভেজ।
তরঙ্গের চাহিদা মূল্যায়ন ও বরাদ্দের বিদ্যমান পদ্ধতিগুলো ত্রুটিপূর্ণ উল্লেখ করে বক্তারা বলেন, রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি স্পেকট্রাম দীর্ঘদিন ধরে জটিল নিয়ন্ত্রণ কাঠামো ও নীতির মাধ্যমে পরিচালিত হয়েছে। রেডিও কমিউনিকেশন এবং তরঙ্গকেন্দ্রিক পরিসেবা যেহেুতু বৃদ্ধি পাছে তাই তাই উদ্ভাবনী কৌশলের মাধ্যমে এর সর্বোত্তম ব্যবস্থাপনার পরামর্শ দেন তারা।
বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা, নেপাল, ভুটান, আফগানিস্তান, মালদ্বীপ, ইরান, অষ্ট্রেলিয়া, মঙ্গোলিয়া, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, কোরিয়া, মায়ানমার, ভিয়েতনাম, ভানুয়াতু, সামোয়া, টোঙ্গো এবং লাওস-এর রেগুলেটরি সংস্থার প্রধান, টেলিকম অপারেটর, সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার কর্মকর্তা, টেলিকম বিশেষজ্ঞের ২০০ জন প্রতিনিধি অংশগ্রহণ করেছেন।
এপিটির সহযোগী সদস্য প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে অংশগ্রহণ করেছে জাপানের কেডিডিআই কর্পোরেশন, গ্লোবাল স্যাটেলাইট অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন, অ্যামাজন, মেটা, স্টারলিংক, কোয়ালকম ইন্ডিয়া, হুয়াইয়ে টেকনোলজিস, টেলিনর এশিয়া, অষ্ট্রেলিয়ার উইন্ডশোর প্যালেস কনসাল্টিং, জাপানের ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব কমিউনিকেশন এন্ড টেকনোলজি, সিংগাপুরের CISCO ও INMARSAT এবং GSMA (Hongkong)।