টেকসিঁড়ি রিপোর্টঃ ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ সম্প্রতি ‘বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ অধ্যাদেশ, ২০২৫’-এর খসড়া প্রকাশ করেছে, যা দুই দশকের পুরোনো আইনকে আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে চাইছে। মূলত মোবাইল লাইসেন্স ও তদারকিতে সীমাবদ্ধ থাকা ২০০১ সালের আইনটির পরিসর এখন ইন্টারনেট, সামাজিক মাধ্যম, ওটিটি, ভিডিও স্ট্রিমিং, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) এবং ইন্টারনেট অব থিংস (আইওটি) সহ সকল প্ল্যাটফর্মকে অন্তর্ভুক্ত করবে।
খসড়ার মূল পরিবর্তন ও প্রভাব
বিস্তৃত তদারকি ক্ষেত্র: বিদ্যমান আইন ছিল শুধু মোবাইল অপারেটরদের জন্য। নতুন খসড়ায় ইন্টারনেট, সোশ্যাল মিডিয়া, ওটিটি প্ল্যাটফর্ম (যেমন – ফেসবুক, ইউটিউব, নেটফ্লিক্স), এআই ও আইওটি– সবকিছুকে তদারকির আওতায় আনা হয়েছে।
অনলাইন প্ল্যাটফর্মের নিবন্ধন বাধ্যতামূলক: বাংলাদেশে সেবা প্রদানকারী যেকোনো অনলাইন প্ল্যাটফর্মের (দেশীয় ও বিদেশী ওটিটি সহ) জন্য সরকারের অনুমোদন ও নিবন্ধন গ্রহণ আবশ্যক হবে। প্রয়োজনে নিরাপত্তা সংস্থাকে তথ্য দেওয়া এবং ব্যবহারকারীর তথ্য সংরক্ষণে সরকারের নির্দেশ মানতে হবে।
বিশেষজ্ঞের উদ্বেগ: প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ সুমন আহমেদ সাবির সহ অনেকে মনে করেন, এটি রাষ্ট্রের দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করলেও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও ব্যক্তিগত গোপনীয়তার ওপর নতুন নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে পারে। তিনি খসড়াতে নাগরিকের তথ্য সুরক্ষার নিশ্চয়তা স্পষ্ট না থাকায় নজরদারি রাষ্ট্র তৈরি হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
শর্তসাপেক্ষ আড়িপাতা ও নজরদারি কাঠামো
নতুন নজরদারি প্ল্যাটফর্ম (CLIPP): খসড়ার ধারা ৯৭ ও ৯৭(খ) অনুযায়ী, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা, জনশৃঙ্খলা বা অপরাধ তদন্তের প্রয়োজনে আদালতের অনুমোদন ও নির্দিষ্ট শর্ত সাপেক্ষে যোগাযোগে নজরদারির বিধান রাখা হয়েছে। এই কার্যক্রমের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি নতুন প্ল্যাটফর্ম, কেন্দ্রীয় আইনানুগ ইন্টারসেপশন প্ল্যাটফর্ম (সিএলআইপি – CLIP), গঠিত হবে।
পুরোনো কাঠামোর বিলুপ্তি: সিএলআইপি কার্যকর হলে বিদ্যমান ন্যাশনাল টেলিকম মনিটরিং সেন্টার (এনটিএমসি)-এর কার্যক্রম বাতিল বলে গণ্য হবে।
বিটিআরসির ক্ষমতা হ্রাস: ‘নতুন কমিশন, তবে ক্ষমতাহীন’
কমিশনের নাম ও কাঠামো পরিবর্তন: বর্তমান ‘বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন’ (বিটিআরসি)-এর পরিবর্তে নতুন ‘বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ কমিশন’ গঠিত হবে, যা পাঁচ সদস্যের (চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান ও তিনজন সদস্য) সংবিধিবদ্ধ সংস্থা হিসেবে ঘোষিত হবে।
সরকারের উপর নির্ভরশীলতা: নতুন খসড়ায় বলা হয়েছে, ‘কমিশন তার সিদ্ধান্ত গ্রহণে সরকারের নীতি ও দিকনির্দেশনা অনুসরণ করবে।’ লাইসেন্স দেওয়া, বাতিল করা এবং বড় ধরনের ট্যারিফ নির্ধারণের ক্ষেত্রে সরকারের নীতি-নির্ধারণী কমিটি বা অনুমতির প্রয়োজন হবে।
স্বাধীনতা নিয়ে প্রশ্ন: ২০০১ সালের আইনে বিটিআরসি একটি স্বশাসিত প্রতিষ্ঠান ছিল। খসড়ায় কমিশনের ক্ষমতা সরকারের ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় এর স্বাধীনতা কার্যকর হবে কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। একজন সাবেক কমিশনারের মতে, ‘নীতিগত ক্ষমতা সরকারের হাতে থাকলে স্বাধীনতা বাড়ানো যাবে না।’
উদ্যোক্তাদের আশঙ্কা: প্রযুক্তি উদ্যোক্তারা বলছেন, লাইসেন্সিং প্রক্রিয়া অতিরিক্ত জটিল হলে নতুন স্টার্টআপ ও উদ্ভাবনী উদ্যোগ বাধাগ্রস্ত হতে পারে।
পরিশেষে বলা যায়, নতুন আইনটি সময়ের দাবি মেটালেও এর প্রয়োগ কাঠামোতে ব্যক্তিগত স্বাধীনতা, তথ্য সুরক্ষা ও প্রাতিষ্ঠানিক স্বাধীনতার ভারসাম্য থাকা জরুরি বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞ ও অংশীজনরা। খসড়ার ওপর ১৫ নভেম্বর পর্যন্ত মতামত প্রদানের সুযোগ রয়েছে।

