টেকসিঁড়ি রিপোর্ট : সম্প্রতি ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার বা আইএসপি লাইসেন্স চেয়েছে বাংলালিংক। বিটিআরসি চেয়ারম্যানের কাছে লাইসেন্স চেয়ে আবেদন করেছেন বাংলালিংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও এরিক অস।
দেশের আইএসপি ব্যবসায়ীরা, মনে করেন এটি দেশের টেলিকম ও প্রযুক্তি খাতের জন্য ক্ষতিকর হবে। এই উদ্বেগের পেছনে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ রয়েছে, যা দেশের অর্থনীতি, উদ্যোক্তা এবং ব্যবহারকারীদের ওপর দীর্ঘমেয়াদী নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে বলে তারা জানান।
বাংলাদেশের আইএসপি শিল্প প্রায় ২৫ বছর ধরে গড়ে উঠেছে, যেখানে হাজার হাজার স্থানীয় উদ্যোক্তা বিনিয়োগ করেছেন। মোবাইল অপারেটরদের আইএসপি ব্যবসায় প্রবেশ করার অনুমতি দেওয়া হলে তাদের বিশাল মূলধনের সুবিধা ও বাজারের একচেটিয়া ক্ষমতার কারণে ক্ষুদ্র ও মাঝারি আইএসপি প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস হয়ে যাবে বলে মনে করেন আইএসপি ব্যবসায়ীরা সহ সংশ্লিষ্ট সচেতন মহল। তারা মনে করেন, এটি দেশের স্থানীয় উদ্যোক্তাদের টিকে থাকার সম্ভাবনাকে ক্ষীণ করে দেবে, যা অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়ার শঙ্কা তৈরি করবে।
এ প্রসংগে টেকসিঁড়ি ডট কমকে আইএসপিএবির পরিচালক সাকিফ আহমেদ জানান, বাংলাদেশের মোবাইল অপারেটরগুলোর মালিকানার একটি বড় অংশ বিদেশি বিনিয়োগকারীদের হাতে। যদি তারা আইএসপি ব্যবসায় প্রবেশ করে, তাহলে এ খাতে উৎপাদিত রাজস্বের বিশাল অংশ দেশ থেকে বেরিয়ে যাবে। বর্তমানে স্থানীয় আইএসপিগুলো যে আয় করে, তার পুরোটাই দেশের মধ্যেই থাকে, যা কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও স্থানীয় অর্থনীতিকে চাঙ্গা রাখতে সহায়তা করে।
মোবাইল অপারেটরদের যদি আইএসপি ব্যবসায় প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়, তাহলে তারা ধাপে ধাপে স্থানীয় আইএসপি গুলোকে বাজার থেকে সরিয়ে দিয়ে একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে প্রতিযোগিতা কমে গেলে ইন্টারনেট সেবার দাম বাড়বে এবং মানের অবনতি ঘটবে। অন্যদিকে, বর্তমানে স্থানীয় আইএসপিরা প্রতিযোগিতার মাধ্যমে গ্রাহকদের জন্য সেরা সেবা নিশ্চিত করছে, যা ভবিষ্যতে সম্ভব নাও হতে পারে।
তিনি বলেন, মোবাইল অপারেটররা অতীতে বারবার প্রমাণ করেছে যে, তারা স্বচ্ছ ও প্রতিযোগিতামূলক বাজার চায় না। তারা দীর্ঘদিন ধরে আইএসপিদের জন্য ব্যান্ডউইথের দাম কমাতে চায়নি, বরং নিজেদের সেবাগুলোকে প্রাধান্য দিতে চেষ্টা করেছে। এমনকি অনেক সময়, আইএসপিদের ব্যবসা ব্যাহত করার জন্য তারা নানা ধরনের অনৈতিক কৌশল গ্রহণ করেছে। এ ধরনের মনোভাবের কারণে আইএসপি শিল্পের ভবিষ্যৎ শঙ্কার মধ্যে পড়ে যাবে, যা দেশের জন্য ক্ষতিকর।
ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট ও মোবাইল ইন্টারনেটের মধ্যে প্রযুক্তিগত পার্থক্য রয়েছে। মোবাইল অপারেটররা মূলত তারবিহীন (Wireless) প্রযুক্তির মাধ্যমে সেবা দিয়ে থাকে, যা স্থিতিশীল ব্রডব্যান্ড সংযোগের বিকল্প হতে পারে না। বর্তমান আইএসপিরা অপটিক্যাল ফাইবার, মাইক্রোটিক, এবং জিপন (GPON) প্রযুক্তি ব্যবহার করে উচ্চগতির, নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারনেট সেবা দিচ্ছে। মোবাইল অপারেটররা যদি একই বাজারে প্রবেশ করে, তাহলে তাদের মূল লক্ষ্য হবে লাভ বাড়ানো, যা সেবার মান ও নির্ভরযোগ্যতার সঙ্গে সাংঘর্ষিক হতে পারে।
তিনি দুঃখের সাথে বলেন, বাংলাদেশের আইএসপিরা দীর্ঘদিন ধরে নানা প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে টিকে আছে। ব্যান্ডউইথের দাম, লাস্ট মাইল সংযোগ, নীতিগত জটিলতা—এসব বাধা অতিক্রম করেই তারা গ্রাহকদের সেবা দিয়ে আসছে। যদি মোবাইল অপারেটরদের একই বাজারে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়, তাহলে তারা নিজেদের অবকাঠামো ও সংযোগ ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে আইএসপিগুলোর ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করবে, যা তাদের অস্তিত্ব হুমকির মুখে ফেলবে।
সরকার “আধুনিক বাংলাদেশ” বিনির্মাণের লক্ষ্যে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছে। এর মূল চালিকাশক্তি দেশের হাজার হাজার আইএসপি, যারা প্রত্যন্ত অঞ্চলেও ইন্টারনেট সেবা পৌঁছে দিয়েছে। স্থানীয় আইএসপিরা প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ও স্থানীয় কর্মসংস্থান সৃষ্টি করছে, যা একটি সুস্থ প্রতিযোগিতামূলক বাজারে অবদান রাখে। বিদেশি মালিকানাধীন মোবাইল অপারেটরদের এই বাজারে ঢুকতে দেওয়া হলে, তারা এই ইতিবাচক প্রবণতাকে নষ্ট করতে পারে।
তিনি বলেন, আমাদের স্পষ্ট মতামত হলো, মোবাইল অপারেটরদের আইএসপি লাইসেন্স দেওয়া হলে দেশের অর্থনীতি, উদ্যোক্তারা এবং গ্রাহকরা ক্ষতির সম্মুখীন হবে। একচেটিয়া বাজার তৈরি হলে ইন্টারনেট সেবার মান কমবে, মূল্য বৃদ্ধি পাবে এবং স্থানীয় আইএসপি শিল্প ধ্বংস হয়ে যাবে। দেশের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিয়ে, আমরা সংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারকদের কাছে দাবি জানাই যে, মোবাইল অপারেটরদের আইএসপি ব্যবসায় প্রবেশের অনুমতি না দিয়ে স্থানীয় আইএসপিগুলোর স্বাভাবিক বিকাশ নিশ্চিত করা হোক।
ভোক্তা অধিকার নিয়ে সোচ্চার সংগঠন বাংলাদেশ মুঠোফোন এসোসিয়েশনের সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ মোবাইল অপারেটরদের আইএসপি লাইসেন্স চাওয়ার ব্যাপারে বলেন, বাংলালিংক (আইএসপি) ব্রডব্যান্ড লাইসেন্স পেলে হয়তো খুব দ্রুতই প্রান্তিক পর্যায়ে নেটওয়ার্ক পৌঁছে দিতে পারবে। কিন্তু আমাদের ক্ষুদ্র ও মাঝারি আইএসপি অপারেটর হারিয়ে যাবে। নিয়ন্ত্রক কমিশনকে অসম বাজার প্রতিযোগিতা যাতে সৃষ্টি না হয় সে বিষয়ে খেয়াল রেখেই লাইসেন্স প্রদান বা ব্যবস্থা নিতে হবে।
তিনি আরও বলেন, আমাদের দেশের একটি প্রবণতা হচ্ছে যারা ভূমি দস্যু এবং ভোজ্য তেল সিন্ডিকেট কারী চার পাঁচটি প্রতিষ্ঠান আছে দেশে তারা একদম ক্ষুদ্র পর্যায়ে যারা মুড়ি বিক্রি করে সেই ব্যবসার দিকেও তাদের নজর। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনকে এ বিষয়টি খেয়াল রাখতে হবে। ক্ষুদ্র মাঝারি ব্যবসা যখন বৃহৎ প্রতিষ্ঠানে হাতে চলে যায় তখন অলিগোপলি সৃষ্টি হয়। তাই এ ব্যাপারে সবদিক বিচার বিবেচনা করে প্রয়োজনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত বলে মনে করি।
আইএসপি ব্যবসায়ী শুভ্র সরকার শুভ্র টেকসিঁড়ির প্রশ্নের জবাবে বলেন, আমরা কেউ কি কখনো ভেবেছি যে, চেইনশপে এসিতে আমাদের নিত্য পণ্য খরিদ করবো? কারন ভেবেছি – আমাদের পাড়া মহল্লাসহ পাইকারী বাজারেও বেচা-কিনায় ধস নামবে। কিন্তু তা তো পরিলক্ষিত হচ্ছে না। ছোট প্রোভাইডরদের অবস্থান কিন্তু তাই। তবে সরকার মোবাইল অপারেটরদের মতো আইএসপি-দেরকেও মোবাইল ফোন লাইসেন্স দিতে পারেন।
বেসিসের সহায়ক কমিটির চেয়ারম্যান রাফায়েল কবীর বলেন, এই মুহূর্তে কোন টেলিকম অপারেটরকে আইএসপি লাইসেন্স দেয়া উচিত না। কারণ তাঁরা ইতোমধ্যে গ্রাহকদের ওয়্যারলেস ইন্টারনেট দিচ্ছে । অপারেটরদের আধিপত্যে দেশে প্রাইভেট সেক্টর থাকবে না । এটা আইনের সাথে সাংঘর্ষিক হবে। দেশের অর্থনীতির ভালোর জন্য দেশের কোম্পানিকে ফোকাস দেয়ার উপর গুরুত্ব দেন তিনি। বিদেশী কোম্পানীদের মনোপলী বিজনেস বন্ধের আহ্বান জানান।
জানা গেছে অপারেটরটির শীর্ষ কর্মকর্তারা এই কাজটি ইকোসিস্টেমে থাকা কারও সঙ্গে পার্টনারশিপ মডেলে করতে চান।