টেকসিঁড়ি রিপোর্ট : চীন তাদের চিপ নির্মাতাদের ৫০% দেশীয় সরঞ্জাম ব্যবহারের নিয়ম বাধ্যতামূলক করেছে। বিদেশি প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীলতা কমানোর ক্ষেত্রে বেইজিংয়ের নেওয়া এটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
বিশেষ করে ২০২৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র যখন উন্নত এআই চিপ এবং সেমিকন্ডাক্টর সরঞ্জাম বিক্রির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ কঠোর করে, তারপর থেকেই চীনের এই প্রচেষ্টা আরও বেগবান হয়েছে।
তিনটি বিশ্বস্ত সূত্রের বরাত দিয়ে রয়টার্স জানিয়েছে, একটি স্বনির্ভর সেমিকন্ডাক্টর সরবরাহ শৃঙ্খল তৈরির লক্ষ্যে চীন এখন থেকে চিপ নির্মাতাদের নতুন সক্ষমতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে অন্তত ৫০% দেশীয় সরঞ্জাম ব্যবহার করার নির্দেশ দিচ্ছে।
এই নিয়মটি জনসমক্ষে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হয়নি। তবে সাম্প্রতিক মাসগুলোতে নতুন কারখানা স্থাপন বা বিদ্যমান কারখানার সম্প্রসারণের জন্য সরকারি অনুমোদনের আবেদনকারী চিপ নির্মাতাদের কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে যে, তাদের অবশ্যই টেন্ডারের মাধ্যমে প্রমাণ করতে হবে যে প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের অন্তত অর্ধেক চীনা প্রযুক্তিতে তৈরি।
যদিও মার্কিন রপ্তানি নিষেধাজ্ঞার ফলে শুধুমাত্র নির্দিষ্ট কিছু উন্নত প্রযুক্তির সরঞ্জাম বিক্রিতে বাধা ছিল, কিন্তু এই ‘৫০% নিয়ম’ কার্যকর হওয়ার ফলে চীনা নির্মাতারা এখন যেখানে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া বা ইউরোপের সরঞ্জামগুলো এখনো বাজারে সহজলভ্য এমন সব ক্ষেত্রেও দেশীয় সরঞ্জাম বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছে।
সূত্রগুলো জানায়, যে সব আবেদন এই ৫০ শতাংশের শর্ত পূরণ করতে ব্যর্থ হচ্ছে, সেগুলো সাধারণত প্রত্যাখ্যান করা হচ্ছে। তবে সরবরাহের সীমাবদ্ধতার ওপর ভিত্তি করে কর্তৃপক্ষ কিছুটা শিথিলতাও প্রদর্শন করছে। বিশেষ করে উন্নত চিপ উৎপাদন লাইনের ক্ষেত্রে এই নিয়ম কিছুটা শিথিল, কারণ সেসব ক্ষেত্রে দেশীয় সরঞ্জাম এখনো পুরোপুরি তৈরি হয়নি।
একজন সূত্র রয়টার্সকে বলেন, “কর্তৃপক্ষ এই হার ৫০ শতাংশের অনেক বেশি দেখতে পছন্দ করে। শেষ পর্যন্ত তাদের লক্ষ্য হলো এমন এক পর্যায়ে পৌঁছানো যেখানে কারখানাগুলোতে ১০০% দেশীয় সরঞ্জাম ব্যবহৃত হবে।”
চীনের শিল্প মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে মন্তব্যের অনুরোধে কোনো সাড়া দেয়নি। বিষয়টি যেহেতু এখনো অপ্রকাশিত, তাই তথ্য প্রদানকারী ব্যক্তিরা তাদের নাম প্রকাশ করতে অনিচ্ছুক ছিলেন।
চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং একটি সম্পূর্ণ স্বনির্ভর অভ্যন্তরীণ সেমিকন্ডাক্টর সরবরাহ শৃঙ্খল তৈরির জন্য “সমগ্র জাতিগত” প্রচেষ্টার ডাক দিয়েছেন। এই মহাপরিকল্পনার সাথে দেশজুড়ে বিভিন্ন কোম্পানি ও গবেষণা কেন্দ্রের হাজার হাজার প্রকৌশলী ও বিজ্ঞানী যুক্ত রয়েছেন।
সরবরাহ শৃঙ্খলের প্রতিটি স্তরেই এই প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। এই মাসের শুরুর দিকে রয়টার্স জানিয়েছিল যে, চীনা বিজ্ঞানীরা অত্যাধুনিক চিপ তৈরি করতে সক্ষম এমন একটি মেশিনের প্রোটোটাইপ বা প্রাথমিক মডেল নিয়ে কাজ করছেন—এমন এক সাফল্য যা রুখতে ওয়াশিংটন বছরের পর বছর ধরে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
স্থানীয় সরঞ্জাম প্রস্তুতকারক কোম্পানি ‘নাউরা টেকনোলজি’র (Naura Technology) একজন প্রাক্তন কর্মী বলেন, “আগে এসএমআইসি-র (SMIC) মতো দেশীয় চিপ কারখানাগুলো মার্কিন সরঞ্জাম পছন্দ করত এবং চীনা প্রতিষ্ঠানগুলোকে খুব একটা সুযোগ দিত না।”
কিন্তু ২০২৩ সালে মার্কিন রপ্তানি নিষেধাজ্ঞার পর সেই চিত্র বদলে গেছে। এখন চীনা চিপ কারখানাগুলোর দেশীয় সরবরাহকারীদের সাথে কাজ করা ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই।
জনসমক্ষে আসা প্রকিউরমেন্ট বা কেনাকাটার তথ্য অনুযায়ী, রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলো এই বছর রেকর্ড ৪২১টি দেশীয় লিথোগ্রাফি মেশিন ও যন্ত্রাংশের অর্ডার দিয়েছে, যার মূল্য প্রায় ৮৫০ মিলিয়ন ইউয়ান। এটি স্থানীয়ভাবে উদ্ভাবিত প্রযুক্তির চাহিদাপ্রাপ্তির এক বিশাল উল্লম্ফন হিসেবে দেখা হচ্ছে।
স্থানীয় চিপ সরবরাহ শৃঙ্খলকে শক্তিশালী করতে বেইজিং তাদের “বিগ ফান্ড”-এর মাধ্যমে সেমিকন্ডাক্টর খাতে শত শত বিলিয়ন ইউয়ান বিনিয়োগ করেছে। এই তহবিলের আওতায় ২০২৪ সালে ৩৪৪ বিলিয়ন ইউয়ান ($৪৯ বিলিয়ন ডলার) মূলধন নিয়ে তৃতীয় ধাপের কার্যক্রম শুরু হয়েছে।


